
২০২১-এর প্রথমার্ধ: ছাত্র আন্দোলনের খতিয়ান
এ বছর প্রথম থেকেই দেশের শিক্ষাঙ্গন ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল ছিল, বিশেষত প্রথম দুই মাস। খুবি ইস্যু ছাড়া বাকি সবগুলোই ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সংকট থেকে উদ্ভুত। বছরের প্রথমার্ধ শেষ হয়েছে, আসুন সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ছাত্র আন্দোলনগুলোর কারণ, ঘটনাপ্রবাহ, দাবী-দাওয়া, দৃশ্যমান ফলাফল, ইত্যাদি।
কারিগরির শিক্ষার্থীদের চার দফা দাবীতে আন্দোলন
জানুয়ারির শুরু থেকেই চার দফা দাবীতে দেশব্যাপী বিভিন্ন আন্দোলনকর্মসূচী পালন করে আসছিলেন পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ পলিটেকনিক ছাত্র পরিষদ নামের ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলন গড়ে তোলে। “পলিটেকনিক সাধারণ শিক্ষার্থী আন্দোলন” নামের ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। এক বছর ক্লাস না হওয়ার পরও পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত ফি আদায় করছে, পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যার অনুপাতে উচ্চশিক্ষা অংশগ্রহণের আসনসংখ্যা সীমিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মান ও অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে, এই সংকটগুলো সামনে আনেন তারা।
দাবিগুলো হচ্ছে—
- অষ্টম পর্বের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ এবং চলমান সব নিয়োগের আবেদনের সুযোগ দেওয়া;
- স্থগিত হওয়া দ্বিতীয়, চতুর্থ পর্বে তাত্ত্বিক অংশগুলোকে উত্তীর্ণ দিয়ে ব্যবহারিক অংশগুলোকে পরবর্তী পর্বে সংযুক্ত করা;
- প্রথম, তৃতীয়, পঞ্চম ও সপ্তম পর্বের সিলেবাস কমিয়ে অনলাইনে ক্লাস করানোর মাধ্যমে দ্রুত পরীক্ষা নেওয়া এবং
- ২০২১ সালের মধ্যে ডুয়েটসহ চারটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ করা।
জানুয়ারির মাঝামাঝিতে ফেনী, রংপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মহাসড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। তবে তখনো এই আন্দোলন আলোচিত হয়ে উঠেনি। এই আন্দোলন শিক্ষার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নাকি নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা সে প্রশ্ন তুলেছিলেন কারিগরি শিক্ষা সচিব।
ঢাকায় নিয়মিত আন্দোলন চলতে থাকলেও এবং পুলিশো বাধার সম্মুখীন হলেও, ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা ঢাকায় যোগ দিয়ে শাহবাগ অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ থেকে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
৮ ফেব্রুয়ারি আটককৃতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারা মোতাবেক ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে অপরাধ সংঘটনের অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।
আদালতে হাজির করা ৫ শিক্ষার্থী হলেন- আন্দোলনের মুখপাত্র মেহেদী হাসান লিমন (২০), নাওয়াহির আলম দিহান (২০), মো. শহিদুল ইসলাম সোহেল (১৮), মো. হিমেল উদ্দিন (২২) এবং জান্নাতুল ফেরদৌস (২২)।
দেশব্যাপী তা আলোচনায় আসে। আন্দোলনও তুঙ্গে ওঠে, তবে এরপর আন্দোলন মূলত আটককৃতদের মুক্তির দাবীতেই ফোকাস করে। শিক্ষার্থীদের পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়া হয়। আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে।
খুবিতে ছাত্র-শিক্ষক বহিষ্কারের প্রতিবাদ
২০২০ সালের ১ ও ২ জানুয়ারিতে খুবি শিক্ষার্থীরা ৫ দফা দাবীতে একটি আন্দোলন করেছিলেন।
দাবীগুলো ছিল-
- আবসন সংকটের দূরীকরণ,
- বেতন ফিসের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিরোধ ও বেতন কমানো,
- দ্বিতীয় পরীক্ষণের ব্যবস্থা ও কোডিং পদ্ধতির ব্যবস্থাকরণ,
- শিক্ষার্থী বিষয়ক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তকরণ ও অবহিতকরণ এবং
- বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত যেসব দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে তার প্রতিকার করা।
আন্দোলন চলাকালীন দু’জন শিক্ষকের সঙ্গে অসদাচরণ এবং তদন্ত ও একাডেমিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করার অভিযোগ এনে দুইজন শিক্ষার্থী বাংলা ডিসিপ্লিনের মোহাম্মদ মোবারক হোসেন নোমান (১৮ ব্যাচ) এবং ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিনের ইমামুল ইসলামকে বহিষ্কার করে খুবি প্রশাসন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানানোয়, ২০২০ সালে খুবির ৪ শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে, অবাধ্যতা, গুরুতর অসদাচরণ, প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন ইত্যাদি অভিযোগ দেখিয়ে বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবুল ফজলকে বরখাস্ত এবং একই বিভাগের প্রভাষক শাকিলা আলম এবং ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের প্রভাষক হৈমন্তী শুক্লা কাবেরীকে অপসারণ করা হয়। দুইজন সিণ্ডিকেট সদস্য সিণ্ডিকেট সভায় শিক্ষকদের এই বরখাস্ত অপসারণের বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করে। তার কোনও তোয়াক্কা করা হয়নি। ২৩ জানুয়ারি,২০২১ তারিখের বিশেষ সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে চূড়ান্ত বরখাস্ত ও অপসারণ করা হয়। ২৮ তারিখে ভিসি মেয়াদশেষে চলে যাওয়ার পর তিন শিক্ষক সেই আদেশ পান। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তারা ব্যাখ্যা প্রদানের জন্যে ৭ কর্মদিবস সময় পাননি।
দুই শিক্ষার্থী ১৯ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রশাসনিক ভবনের সামনে বহিষারাদেশ প্রত্যাহারের দাবীতে আমরণ অনশন শুরু করেন। পরবর্তীতে দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। ২৬ জানুয়ারি রাত ৮টায় আশ্বাস পেয়ে আমরণ অনশন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
এরমধ্যে, এ ইস্যুতে দেশের বিভিন্ন স্থানে লাগাতার আন্দোলন হতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রতিবাদে শামিল হন।
শিক্ষকদের বরখাস্ত ও দুই শিক্ষককে অপসারণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হওয়ায় প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে খুবিতে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি শিক্ষকরা আন্দোলন স্থগিত করলেও ছাত্রদের আন্দোলন চলতে থাকে। টানা ৪৪ দিন এই আন্দোলন চলে। করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন ঘোষিত হলে ছাত্ররা আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করে। শাস্তি প্রত্যাহার চেয়ে খুবি প্রশাসনকে ৩ শিক্ষক আইনি নোটিশ দিয়েছিলেন, ৯ই ফেব্রুয়ারিতে তাদেরকে চাকরিতে বহালের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। কিন্তু খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা অমান্য করে শিক্ষকদের বেতন বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ ৫ মাস তারা বেতন পাচ্ছেন না বলে জানা যায়। অভিযোগ ওঠে, তৎকালীন উপাচার্য মো. ফায়েক উজ্জামান ব্যক্তিগত রোষের জের ধরে তড়িঘড়ি করে মেয়াদশেষের আগে এই বহিষ্কারাদেশ দেন। নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন ২৪শে মে দায়িত্ব নেন, তবে এখনো শিক্ষকদের ব্যাপারে কোনো সুরাহা হয়নি।
ববিতে শিক্ষার্থীদের উপর পরিবহন শ্রমিকদের হামলার প্রতিবাদ
১৬ই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে পরিবহন শ্রমিকেরা। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে নগরের রূপাতলী হাউজিং এলাকার কয়েকটি সড়কে শিক্ষার্থীদের মেসে এসব হামলা হয়। অন্তত ১১ জন ছাত্র আহত হয়। এর আগে ওইদিন ববি’র শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত ও ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কঅবরোধ করেছিল শিক্ষার্থীরা। হামলার প্রতিবাদে ১৭ তারিখ বুধবার সকাল সাতটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। তারা ৩ দফা দাবি জানান।
দাবীগুলো হলো–
- ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার পদক্ষেপ গ্রহণ,
- এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা করা
- এবং অনাবাসিক সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা বিধানে পদক্ষেপ নেওয়া।
ববি উপাচার্য দাবী বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে অবরোধ্ প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান, তবে এই দাবিগুলো আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা অবরোধ প্রত্যাহার করবেন না বলে জানিয়েছেন। অবরোধে বাসে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে। ২য় দিনও অবরোধ চলে। এদিন ববি শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ঢাবিতেও মানববন্ধন হয়। ১৯ তারিখ শিক্ষার্থীদের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পরও কোন হামলাকারীকে গ্রেপ্তার না করায়, ফের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। এতে দক্ষিণবঙ্গের প্রায় পাঁচ জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িতদের গ্রেফতারের আশ্বাস এবং পরবর্তীতে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না এমন নিশ্চয়তা নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি বুধবার আন্দোলনের সমাপ্তি টানেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
জাবি শিক্ষার্থীদের উপর স্থানীয়দের হামলার প্রতিবাদ
ববি’র ঘটনা চলমান অবস্থায়ই ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় জাবি শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়দের হামলার ঘটনা ঘটে। ৩৭ ছাত্র আহত হয়। শিক্ষার্থীদের চারটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সংলগ্ন গেরুয়া গ্রামের স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ১০ রাউন্ড গুলি নিক্ষেপ করে। উত্তেজনা বৃদ্ধিতে স্থানীয় মসজিদগুলোতে মাইকিংও করা হয়। প্রথমে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে জাবি শিক্ষার্থীরা দ্বন্দ্বের জের ধরে হামলাটি ঘটে বলে জানা যায়। পরবর্তীতে এর নেপথ্যে ছাত্রলীগের চাদাবাজি জড়িত বলে স্থানীয়রা অভিযোগ ওঠে। এ প্সঙ্গে জাবি উপচার্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘গেটের বাইরে আমার প্রক্টর ও নিরাপত্তা কর্মীদের কিছু করার নেই।’
পরদিন শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে জড়ো হতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর বেলা ১১টার দিকে তিনটি দাবি পেশ করেন তারা।
দাবিগুলো হলো–
- শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার ও বিচার ও আহত শিক্ষার্থীদের ব্যয় বহন,
- গেরুয়ার সঙ্গে ক্যাম্পাসের সংযোগ স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া
- এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল খুলে দেওয়া।
এরপর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ফটকের তালা ভাঙতে শুরু করেন। একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবক’টি হলে প্রবেশ করেন তারা। বিকেলের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আল বেরুনী হলসহ ছাত্রীদের বেশকটি হলে তালা ঝুলিয়ে দেয় প্রশাসন। তবে রাতে ছাত্ররা হলে অবস্থান করে।
হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতনামা ২৫০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়।
২২ ফেব্রুয়ারি হলের প্রাধ্যক্ষরা ছাত্রদেরকে আহ্বান জানান হলত্যাগের জন্য, ছাত্ররা তা প্রত্যাখ্যান করে। বরং ছাত্রীরাও তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করে।
২৩ তারিখ মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বরে আন্দোলন আগামীকাল বুধবার পর্যন্ত স্থগিত করার কথা জানানো হয়। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত হলেই থাকবেন বলে ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা। ওইদিন বিকালে প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক জব্বার হলের শিক্ষার্থীদেরকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এরপর বঙ্গমাতা হল থেকেও ছাত্রীদেরকে বের করে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রশাসনের আশ্বাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে তারা আজকের কর্মসূচী স্থগিত করেছেন। তাদের দাবিগুলো মানা না হলে তারা কাল থেকে আবারও কঠোর আন্দোলন শুরু করবেন। আহতদের ব্যয়ভার প্রশাসন বহন করলেও হল-ক্যাম্পাস খোলা হয়নি, তবে জাবি’র আন্দোলনটি সারাদেশে হল-ক্যাম্পাস খোলার দাবীকে তীব্র করে তোলে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হল খোলার দাবীতে আন্দোলন
জাবিতে তালা ভেঙে হলে প্রবেশের ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আগে থেকেই কিছু জায়গায় আন্দোলন হলেও, জাবির ঘটনার পরপরই হল-ক্যাম্পাস খোলার দাবীতে দেশব্যাপী আন্দোলন জোরদার হয়। ২০ ফেব্রুয়ারিতে হল খোলার দাবিতে শাবিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান, ২১ ফেব্রুয়ারিতে হল খোলার দাবিতে ইবিতে শতাধিক শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ, রাবিতে মিছিল, ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ইত্যাদি ঘটনা ঘটতে থাকে। জাবিতে দাবী চলমান অবস্থাতেই, পরদিন ২২ তারিখ ঢাবিতে হলের তালা ভাঙে শিক্ষার্থীরা। দাবী আদায় হয়নি, উলটো আন্দোলন দমানোর জন্য চলমা সকল ধরণের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
সকল পরীক্ষা স্থগিতের প্রতিবাদে আন্দোলন
ঘটনা দ্রুত গড়াতে থাকে। এতদিন হল বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন পরীক্ষা নেয়া চলমান ছিল। হঠাত করেই ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের সব পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা আসতে থাকে। দেশব্যাপী এবার আন্দোলন মোড় নেয় এই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের দাবীতে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ, ঢাবি, চবি, রাবি, জাবি, শাবি, ববি, ইবিসহ বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলমান রাখার দাবীতে মিছিল, সড়ক অবরোধ ইত্যাদি বিক্ষোভ চলতে থাকে। করোনায় দীর্ঘ সেশনজটের পরিস্থিতিতে পরীক্ষা বন্ধ করে ফেলাকে শিক্ষার্থীরা প্রতিশোধপরায়ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করে। আন্দোলন থেকে সরাসসি কোনো সুফল আসেনি। বিভিন্ন মেস-ভাড়াবাসা থেকে শিক্ষার্থীদেরকে বাড়িতে ফিরে যেতে হয়।
পরীক্ষা নেয়ার দাবীতে সাত কলেজের আন্দোলন
সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা করোনার আগেই এক থেকে দেড় বছর সেশনজটে ছিল। ১৫-১৬ সেশনের মাত্র একটি পরীক্ষা বাকি ছিল। স্থগিতের সিদ্ধান্তে তারা কঠোর প্রতিবাদ জানায়। ২৪ ফেব্রুয়ারিতে চলমান পরীক্ষার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং হল ক্যাম্পাস খুলে দেওয়ার দাবিতে নীলক্ষেত মোড়ে অবস্থান নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজ শিক্ষার্থীরা। পুলিশ মানা করার পরও রাজপথ ছাড়েন নি তারা। শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে সাত কলেজের পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। দৃশ্যমা ফলাফলের দিক থেকে এটি ২০২১ সালের একমাত্র সফল আন্দোলন ছিল বলা যায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি শিক্ষার্থীদের
কিছুদিন স্তিমিত থাকার পর মে মাসে আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবীতে আন্দোলন শুরু হয়। লক্ষাধিক সদস্যের একটি ফেসবুক গ্রুপ “অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন” থেকে এ আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চলতে থাকে।
২৪ মে ঢাকা প্রেসক্লাবে অন্তত দশটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।মানববন্ধন করে। বশেমুরবিপ্রবি, জাবি, কুবি, ইবিসহ নানা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ হয়। ঠাকুরগাঁও, পটুয়াখালী, সিলেট, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রামসহ সারাদেশের নানান স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যবহত রাখে। ৩০ মে সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আবার রাস্তায় নামে। কুবিতে প্রশাসনিক ভবনে তালা দেয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে প্রতীকী ক্লাসের কর্মসূচী নেয়া হয়। ৬ জুন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে কর্মসূচীর ঘোষণা দিলে ছাত্রলীগ সেখানে পালটা ‘মাদক, সন্ত্রাস ও মৌলবাদ মুক্ত ক্যাম্পাসের’ দাবিতে কর্মসূচী পালন করে। আস্তে আস্তে আন্দোলন আবার স্তিমিত হয়ে পড়ে, সরকারের তরফ থেকে টানা লকডাউনের ঘোষণা এর একটি কারণ।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর : শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আন্দোলন চলমান অবস্থাতেই, ২০২১-২২ বাজেটে বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করে অর্থমন্ত্রী। প্রগতিশীল সংগঠনগুলো ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এটি বাতিলের দাবী জানায়। ৪ জুনে ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে কর প্রত্যাহারসহ ৬ দফা দাবীতে সংবাদ সম্মেলন করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ ব্যানারসহ বিভিন্ন উদ্যোগে দেশের কিছু স্থানে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলন হতে থাকে। ২০১৫ সালের সফল ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনকে আন্দোলনকারীরা আলোচনায় আনে। তবে এবারের আন্দোলন জোরালো হতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল কম। ২০১৫ সালে বাতিল করা সিদ্ধান্তকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে আবার আরোপ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে আন্দোলনকারীরা।
বলা যায়, সরাসরি সফলতা পেয়েছে সাত কলেজের আন্দোলন। খুবি’র আন্দোলন আংশিক সফল, শিক্ষকদের স্বপদে বহালের সম্ভাবনা আছে এখনো। করোনার অজুহাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বারবার পেছানো হলেও অসন্তোষ ও চাপ বাড়ছে ক্রমাগত। তবে শুধু এভাবে নিশ্চয়ই কোনো আন্দোলনের সফলতা নিরূপণ করা যায় না। আন্দোলনের ফলে শিক্ষার্থীরা যদি শত্রু-মিত্র চিনে নিতে পারে, সেটিও কম কথা নয়।
পুনশ্চ: এই লেখায় উল্লেখ করা সব তথ্যই নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে নেয়া। এ বছরের শুরু থেকে প্রতি মাসেই “ক্রাইসিস ডকুমেন্টেশবন সেন্টার”- ক্রিডো শিক্ষাঙ্গনের সংকট সংক্রান্ত সংবাদগুলোর সংকলন করে রাখে। সেখান থেকেই সব বিবরণী ও তথ্য নেয়া হয়েছে।
লেখা: দেওয়ান তাহমিদ। শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; স্বেচ্ছাসেবী, প্রজেক্ট শিক্ষাঙ্গন সংকট, ক্রিডো।