
মার্চ ২০২০, করোনা ভাইরাসের উত্থান বনাম বাংলাদেশের প্রস্তুতির সংকট
করোনা ভাইরাসের পটভূমিঃ
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর চীনা কার্যালয়ের বিবৃতিতে দেশটির হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নতুন ধরণের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বেশ কিছু রোগী সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করে। নিউমোনিয়ার সাথে নতুন ধরনের করোনাভাইরাস দায়ী বলে জানা যায়। মাত্র চারদিনের মাথায় উহানে প্রায় ৪০ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। [তথ্য সূত্রঃ রোর বাংলা]
চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল জানুয়ারি মাসের গোড়াতে, আর তখন থেকেই আশংকা করা হচ্ছিল যে নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণ চীনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় চীনের উহান শহরকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সরকার। পরে ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় হুবেই প্রদেশেও।
১২ জানুয়ারি, ২০২০ সালে চীনের বাইরে সর্বপ্রথম থাইল্যান্ডে একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ২৫ জানুয়ারি, ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ইউরোপে। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, লি ওয়েনলিয়াং নামে উহানের একজন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। তিনি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ‘সার্স সদৃশ’ এক ভাইরাস সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টার জন্য পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন। লির মৃত্যুর পর চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উহানের সরকারকে নিন্দার ঝড় ওঠে। ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) করোনাভাইরাসকে COVID-19 নামকরণ করে। এভাবে বিশ্বে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঘটা শুরু হয়।চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা শ্লথ হওয়ার পর সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে ইরানে। এরপর ব্যাপক সংক্রমণ আর মৃত্যুর খবর আসতে থাকে ইতালি থেকে।
নভেল করোনাভাইরাস আবিষ্কারের এক সপ্তাহ পর চীনা গবেষকগণ সিকোয়েন্সিং এর পর এই ভাইরাসের জিনগত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে। এই তথ্য ব্যবহার করে ভাইরাসটি নিয়ে বিশদ গবেষণা এবং ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে মানুষ এগিয়ে আসে।
সর্বশেষ ৮ মার্চ বিশ্বে যখন কোভিড-১৯ এর আক্রান্ত সংখ্যা লাখের উপর ছড়ালো তখন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় । রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান Institute of Epidemiology Disease Control and Research (IEDCR) এই তথ্যটি নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংকট ব্যবস্থাপনাঃ
মার্চ মাসে সর্বমোট ১৬০২ টি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে ৫১ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়।করোনায় মৃত্যু ৫ জন। মোট সুস্থের সংখ্যা ২৫ জন।[স্বাস্থ্য অধিদপ্তর]
সামগ্রিক ভাবে মার্চ মাসে করোনা সংকটে সরকারের প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা বাংলাদেশিদের বিমানবন্দরের কাছে আশকোনা হজক্যাম্পে ১৪ দিন কোয়ারান্টিনে রাখা। তখন তারা হজক্যাম্পে নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরেছিলেন।
চীনের সীমানা ছাড়িয়ে করোনা ভাইরাস নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু চীন ছাড়া বাকি দেশ থেকে আসা মানুষজনদের বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানারে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করেই ছেড়ে দেওয়া হয়। থার্মাল স্ক্যানার কাজ না করার অভিযোগ পাওয়া যায়। যারা পরীক্ষা করেন, তারাও ঠিক মতন পরীক্ষা করার নিয়ম জানতেন না। কাজেই বিমানবন্দর থেকে দেশে আগত মানুষদের অনেকেরই দেহে সুপ্ত ভাইরাস থাকতে পারে, যারা হোম কোয়ারান্টিনে না থেকে জনসমাগমে স্বাভাবিক চলাফেরা করেন। বিদেশ থেকে আসা লোকজনও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক দেখাতে বিমানবন্দরে পৌঁছানোর আগে নানা ওষুধ খেয়ে নেন। তারপর হোম কোয়ারান্টিনে না থেকে তারা স্বাভাবিক চলাফেরা করেন।[২৩ মার্চ,ডয়চে ভেলে]
এর মধ্যে ইটালিতে করোনা সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় দলে দলে প্রবাসী দেশে ফিরতে শুরু করেন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের অনিশ্চিত কোয়ারান্টিনে যাওয়া নিয়ে ইটালি প্রবাসীদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বাকবিতণ্ডা ও ভাঙচুর হয়। এতে আশকোনা হজক্যাম্প এবং উত্তরা দিয়াবাড়ির রাজউকের ফ্ল্যাট প্রকল্প এলাকার কোয়ারান্টিনের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে দেওয়া হয়। বিমানবন্দরে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যাদের কোয়ারান্টিনে পাঠাবে তাদের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে।
পাশাপাশি বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপ নিতে হয় বিধায় করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনায় বাংলাদেশে নতুন পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে যেহেতু আঙুলের ছাপের প্রয়োজন নাই তাই পাসপোর্ট রি-ইস্যু বা সংশোধন কাজ অব্যাহত থাকবে।
এসব ব্যবস্থার পরেও বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ৮ মার্চে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত করা হয়। যাদের দুইজন ইটালিফেরত এবং তাদের একজনের মাধ্যমে আরেক নারী আক্রান্ত হয়েছেন। আইইডিসিআর থেকে হটলাইন চালু করা হয়। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান Institute of Epidemiology Disease Control and Research (IEDCR) এই তথ্যটি নিশ্চিত করেছে।
সামাজিক সংক্রমণঃ
৮ মার্চের পর প্রতিদিনই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শুরুর আক্রান্তরা বিদেশফেরত কারো সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯ মার্চ বাংলাদেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সর্বপ্রথম মৃত্যু হয়।সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি আমেরিকা প্রবাসী একজনের সংস্পর্শে এসেছিলেন।
কয়েক দিন পরে আরো একজন সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তি মারা যান, যিনি বিদেশি কারো সংস্পর্শে আসেননি বলে দাবি তার স্বজনদের। অর্থাৎ, সামাজিক সংক্রমণের শুরু হয়ে গিয়েছিলো ইতোমধ্যেই। টোলারবাগে ২১ মার্চ মারা যাওয়া বৃদ্ধের ঘনিষ্ঠজন আরেক বৃদ্ধ পরদিন মারা যান। তিনিও করোনা আক্রান্ত ছিলেন বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। এদিকে টোলারবাগের বৃদ্ধকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া একজন চিকিৎসক করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়। বৃদ্ধকে চিকিৎসা দেয়া আরো তিন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স ও তিন হাসপাতালকর্মী হোম কোয়ারান্টিনে থাকেন। অসুস্থ বোধ করায় হাসপাতালটির পরিচালক নিজেও হোম কোয়ারান্টিনে। বৃদ্ধের সংস্পর্শে এসেছেন এলাকার আরো কয়েকজন অসুস্থ বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর পর রাজধানীর টোলারবাগ এলাকার ৪০টি বাড়ি লকডাউন করে দেয়া হয়েছে। ওই এলাকার বাকি বাসিন্দারা স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারান্টিনে আছেন।এছাড়া ১৯ মার্চ বিকাল থেকে মাদারীপুরের শিবচর লকডাউন ঘোষণা করা হয়। আরো কয়েকটি এলাকা লকডাউন করার খবর পাওয়া গেছে।
সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতঃ
করোনা ভাইরাসের কারণে মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়।
সরকারি ভাবে বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়ার এবং পরিচ্ছন্নতার বিধি মেনে চলার পরামর্শ দেয়া হয়। বিদেশফেরতদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারান্টিনে থাকার নির্দেশ দেয় সরকার। না হলে জরিমানার ব্যবস্থা ছিল। সরকার থেকে সংক্রমণ কমাতে হোম কোয়ারেন্টাইনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনের কথা বলে দায়িত্ব সেরেছে কর্তৃপক্ষ। এসব মানুষ আসলেই বাড়িতে থাকছে কিনা, সেটিও ঠিক মতো পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।
১৭ ই মার্চ,ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বড় রকমের ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। একদিকে নমুনা পরীক্ষার জন্য কীট সঙ্কট। এই মুহূর্তে মাত্র ১৭৫০টি কীট রয়েছে। অন্যদিকে জনসচেতনতাও কম। হাসপাতালগুলোতে বেশির ভাগেরই প্রস্তুতি নেই। মাত্র দুটি হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে বিদেশ ফেরতরা কোয়ারেন্টিনে না থেকে যার যার বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। গত ১ সপ্তাহে প্রায় ১ লাখ মানুষ দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই পরীক্ষার বাইরে থেকে গেছেন। বিশেষ করে ইতালি ফেরতরা কোয়ারেন্টিনে না থেকে বাড়ি চলে যাওয়ায় সংশয় আরো বেড়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই এলাকায় সামাজিক বয়কটের সম্মুখীন হচ্ছেন। বাংলাদেশে রোগ নির্ণয়ের কেন্দ্র রয়েছে মাত্র একটি। প্রতিদিন ১ হাজার জনের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। যদিও বাস্তবে ৩০ জনেরও কম লোকের পরীক্ষা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ নির্ণয় সঠিকভাবে না হলে কত লোক আক্রান্ত হয়েছেন তা বলা সম্ভব নয়। ঐ প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ইকবাল হাসান বলেন,” প্রায় প্রতিদিনই তার কাছে বেশ কিছু রোগী শ্বাসকষ্ট ও জ্বর নিয়ে আসেন। তাদেরকে পরামর্শ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মহাখালী রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে পাঠানোর পর অনেকেই ফিরে এসে বলছেন, তাদের পক্ষে সেখানে ঢোকাই সম্ভব নয়।” [17March,VOA Bangla ]
৮ মার্চে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পরে ১৯ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৭ জন। আইইডিসিআর ব্রিফিং-এ জানা যায়, তখন পর্যন্ত আইসোলেশনে আছেন ৭৭ জন। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৯৩ জন। আর সারাদেশে হোম কোয়রেন্টাইনে আছেন ৯ হাজার ১৩ জন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৩৫ জন। করোনার ৩৯৭টি নমুনা পরীক্ষা করেছিল আইইডিসিআর। তার মধ্যে করোনা পজিটিভ ছিল ১৭ জন। তবে এ পর্যন্ত মোট ‘কল’ এসেছে দুই লাখ ৬০ হাজার। আইইডিসিআর-এর হটলাইনে ৪৪ হাজারেরও বেশি কল এসেছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন তারা সহায়তা পাচ্ছেন না। [২০ মার্চ ,ডয়চে ভেলে ]
আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ মাহমুদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশের সমন্বিত কোন পরিকল্পনা ছিল না। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা করতেও অনেকটা সময় ব্যয় হয়েছে।যে ব্যবস্থাগুলো নেয়া হয় সেগুলো অ্যাডহক, যখন যেটা মনে হয়েছে দরকার, তখন সেটা নেয়া হয়েছে। যেমন আমাদের ল্যাবরেটরি প্রস্তুতি কিছুটা ছিল, কিন্তু পুরোপুরি ছিল না।করোনা ভাইরাসের মতো জীবানু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য যেসব উপাদান দরকার, বাংলাদশে সেগুলো পর্যাপ্ত নেই।এগুলোর আগাম অর্ডার দিতে হয় এবং বিভিন্ন চ্যানেল থেকে আনতে হয়।করোনাভাইরাসের বিস্তার কতটা হয়েছে তা বোঝার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্যাপকভিত্তিতে পরীক্ষা করা হলেও বাংলাদেশে সে ব্যবস্থাই নেই।আমাদের রোগী হাসপাতালে আসলে কোথায় রাখবো, কিভাবে রাখবো, হাসপাতালে রোগীরা কিভাবে ঢুকবে – এখনো সে প্রস্তুতিটা ভালোভাবে করতে পারি নাই।”
তাছাড়া যেসব চিকিৎসক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিবে, তাদের সুরক্ষার জন্য কোন ধরণের সরঞ্জাম প্রয়োজন হবে সেটিও ঠিকমতো নিশ্চিত করা হয়নি বলে মনে করেন মাহমুদুর রহমান।
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যারা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের সবাইকে খুঁজে বের করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে কিনা, তা নির্ণয় করার কোন ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে নেই।তিনি প্রশ্ন তোলেন, কিসের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশের কমিউনিটিতে এখনো করোনাভাইরাসে ছড়ায়নি?
২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দশ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সাধারণ মানুষের ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক ভাবে প্রকৃত তথ্য না করোনা মহামারির আতঙ্কে কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মোবাইল গ্রাহক ঢাকা ছেড়েছেন বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার।[২৮ মার্চ,ঢাকা ট্রাইব্যূন ] রোগের কারণ, উপসর্গ ইত্যাদি সঠিক তথ্য সম্পর্কে অবহিত না থাকায় সাধারণ মানুষ থানকুনি পাতা খেলে করোনা ভালো হয়ে যাবে, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চললেই করোনা হবে না জাতীয় কুসংস্কারেও শুরুতে স্বস্তি খুঁজছে।
করোনা ভাইরাস দুর্যোগ মহামারী নিয়ে ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । তিনি জানিয়েছেন, করোনাভাইরাস চিকিৎসায় ঢাকায় ৬টি হাসপাতাল প্রস্তুত। আরো ৩টি নতুন হাসপাতাল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যকর্মীদেরই সুরক্ষায় পর্যাপ্ত সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম মজুত আছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীরও পর্যাপ্ত মজুত আছে। এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত হবেন না। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত কোভিড পরীক্ষার জন্য ১৩ হাজার কীট মজুত ছিল। আরও ৩০ হাজার কীট শিগগিরই দেশে পৌঁছাবে। ঢাকায় আটটি পরীক্ষাযন্ত্র আছে। আরও সাত বিভাগে করোনাভাইরাস পরীক্ষাগার স্থাপনের কাজ চলছে। তিনি বলেন, কেউ গুজব ছড়াবেন না। গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দুটি সমুদ্রবন্দর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশনসহ সব স্থলবন্দরের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৬ লাখ ৫৮ হাজার ৯৮১ জন যাত্রীর স্ক্রিনিং করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, জানুয়ারি থেকেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যাপক কর্মসূচি এবং প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য ঢাকায় ছয়টি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আরও তিনটি হাসপাতাল প্রস্তুত করা হচ্ছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে পৃথক শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, ঢাকায় ১০ হাজার ৫০টিসহ সারা দেশে ১৪ হাজার ৫৬৫টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সারা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের জন্য ২৯০টি প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এতে ১৬ হাজার ৭৪১ জনকে সেবা দেওয়া যাবে।দাম অতিরিক্ত না রাখার কথা বলে তিনি জানান, বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের ঘরে ফেরা কর্মসূচীর আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা প্রদান করা হবে। গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য বিনামূল্যে ঘর ও ৬ মাসের খাদ্য ও নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। জেলা প্রশাসককে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিল্প উৎপাদন ও রপ্তানি বাণিজ্যে আহগাত আসতে পারে বলে আশংকা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ আঘাত মোকাবেলায় রপ্তানীমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠাণগুলোর জন্য ৫০০০ কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এই অর্থ থেকে শুধু শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেত-ভাতা পরিশোধ করা যাবে। এছাড়াও, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত কাউকে ঋণখেলাপি না করার ঘোষণা দিয়েছে। সেই সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাও আপাতত স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। [২৫ মার্চ,দৈনিক প্রথম আলো]
সংকটের বাস্তব চিত্রঃ
অনেক প্রতিশ্রুতির আশ্বাস থাকলেও মার্চ জুড়ে স্বস্তি মিলেনি সাধারণ মানুষের। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করেন৷ যারা দিন আনে দিন খায়৷ তার উপর রয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা৷ করোনায় শুধু তারাই নন, যারা চাকরিজীবী নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত সবাই সংকটে আছেন৷ এর মধ্যেও যাদের সামর্থ্য ছিল তারা পণ্য কিনে বাড়িতে মজুদ করছে। আবার অনেক ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বিপাকে পড়েছেন পণ্য উৎপাদন কারী প্রান্তিক কৃষক, শ্রম কারখানার শ্রমিক।
খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্ম ক্ষে্ত্রে বেতন সহ ছুটির বা সরকারি প্রণোদনা সহ বিরতির নিরাপত্তা ছাড়া তাদের পক্ষে বাড়িতে আটকে পড়া কোন সুস্থ সমাধান না। পোশাক কারখানায় ৪৫ লাখ কর্মী কাজ করেন৷ সেই খাতটির মানুষ পড়েছে বড় সংকটে৷ ২১ মার্চে বিজিএমইএ ও বিকেএমই এর সভাপতিদের সাথে বৈঠক করে শ্রমিক লীগের সভাপতি, গারমেনট মালিকেরা ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেয়, কারখানা খোলা রাখা হবে। মালিকদের মূল আগ্রহ ছিল সরকারি প্রণোদনা আদায়। ২১ টি শ্রমিক সংগঠন শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে ২২ মার্চ কারখানায় সবেতন ছুটির দাবি করলেও শ্রম মন্ত্রণালয় জানিয়ে দেয়, কারখানা বন্ধের কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি। ২৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব জানায়, গার্মেন্টস বন্ধের সিদ্ধান্ত নেবে মালিকেরা। ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন দিতে ৫০০০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেন। কিন্তু কারখানা বন্ধের ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্যাকেজের প্রতিক্রিয়ায় রুবানা হক এদিন বলেন, বিজিএমইএর কারখানা বন্ধ বা খোলা রাখার এখতিয়ার নেই। এটি সরকারের সিদ্ধান্ত, এ অবস্থায় কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ২৬ মার্চ সরকারী ছুটির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার “আহ্বান” জানায় বিজিএমইএ। এদিন রুবানা হক জানান, মার্চের বেতন মালিকরা দেবেন। এপ্রিলের বেতন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা থেকে দেয়া হবে। তবে এদিন থেকে টেক্সটাইল মিল বন্ধ রাখার ঘোষনা দেয় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন (বিটিএমইএ)। ২৭ মার্চে বিকেএমইএ ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়।একই দিনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর (ডিআইএফই) নির্দেশনা জারী করে যে যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে কলকারখানা বন্ধের কোন নির্দেশনা ছিল না তাই শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে কারখানা খোলা রাখা যাবে। তারা জানায় যে যেসব কারখানায় ক্রয় আদেশ রয়েছে এবং যারা পিপিই, মাস্ক, স্যানিটাইজার ইত্যাদি করোনা প্রতিরোধী সামগ্রী উৎপাদন করছে সেসব কারখানা বন্ধ করার বিষয়ে সরকার কোন নির্দেশনা দেয়নি। মার্চ পর্যন্ত শ্রমিকদের সবেতন নিরাপদ ছুটি নিশ্চিত করা হয়নি। জন মানুষ বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করে ভাইরাস সংকট উত্তরণের আশা পায়নি। (তথ্য সূত্রঃ ঠোঁটকাটা পত্রিকা, ২৫ এপ্রিল ২০২০)
করোনা মহামারীতে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক সংক্রমণের প্রথম কয়েক মাসেই এটি পরিষ্কার যে সারা বিশ্ব আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে বাংলাদেশও যে এই বৈশ্বিক মন্দার শিকার হবে, তা অনুমেয়। বিজেএমইএর সভাপতির কাছে জানা যায় যে গত কয়েক দিনে প্রায় দেড় শ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। এর ফলে ১২ লাখ পোশাকশ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই পরিস্থিতি যদি আরও কয়েক মাস অব্যাহত থাকে, তাহলে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা তা-ও অর্জন সম্ভব হবে না। ফলে আমরা সবাই কমবেশি ভুগব। কিন্তু করোনাভাইরাসের এই চ্যালেঞ্জ সামলাতে যদি কারখানা স্থবির হয়ে যায় এবং শ্রমিকদের বেতন বন্ধ হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ভুগবেন পোশাকশ্রমিকেরা। এঁদের প্রায় সবাই মাসিক বেতনের ওপর নির্ভরশীল। অধিকাংশ শ্রমিকেরই আপদ মোকাবিলার জন্য তেমন কোনো সঞ্চয় নেই, যা দিয়ে এই কঠিন সময় পার করবেন। ফলে জীবনধারণে চরম সংকটের মুখে পড়বেন এঁদের সবাই। আর সবচেয়ে বেশি ভুগবেন ‘দিন আনে দিন খায়’ এ রকম খেটে খাওয়া প্রায় ছয় কোটি মানুষেরা।
করোনা ভাইরাস দূর করার মূল প্রতিবন্ধকতাঃ
ভাইরাস সংকট মোকাবেলার মূল ক্ষেত্র, চিকিৎসা ব্যবস্থায় মার্চ মাস ব্যাপী চরম অব্যবস্থাপনা ছিল। যার মধ্যে রয়েছে রোগ শনাক্তে অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা ও পিপিইর অভাব।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ল্যাবরেটরি কিট আছে এক হাজার ৭৩২টি। ল্যাবরেটরি মাত্র একটি।একমাত্র আইইডিসিআর ছাড়া বাংলাদেশে আর কোথাও করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষা করা যায় না।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান খান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে করোনার টেষ্টিং ল্যাব মাত্র একটি। কিন্তু কাজ হচ্ছে মাত্র রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর (আইইডিসিআর) ল্যাবে।এটা মোটেই যথেষ্ট নয়। এখন ধরা পড়ছে না বলে বোঝা যাচ্ছে না। আর পরীক্ষার সুযোগ না থাকলে ধরা পড়বে কিভাবে? আমরা পরীক্ষা করছি না বলে ধরা পড়ছেনা।”
তিনি বলেন, ‘‘টেষ্টিং ল্যাবরেটরির প্রস্তুতি আমাদের আগেই করা উচিত ছিল। সরকার বিভাগীয় শহরে টেস্টের যে কথা বলছে সেটা আসলে নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআর-এ এনেই পরীক্ষা করা হবে। কোরিয়ায় ৯৬টি ল্যাব। আমাদের যে সেটআপ আছে, তাতে ৪-৫টি ল্যাব করা সম্ভব। কিন্তু আইইডিসিআর সেটা করছে না। কেন করছেনা তারাই জানেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘‘কাজেরও কোনো সমন্বয় নেই। আইইডিসিআর এক কথা বলে আবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা আরেক কথা বলে।”[২০ মার্চ,ডয়চে ভেলে ]
স্বাস্থ্য মহপারিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন আরো দুই হাজার ল্যাবরেটরি টেস্টিং কিট আনা হয়েছে। চীন বাংলাদেশকে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে।
গণস্বাস্থ্য র্যাপিড ডট ব্লট’ নামে করোনা ভাইরাস শনাক্তের একটি টেস্ট কিট আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে গণস্বাস্থ্য। যেটির দাম রাখা হবে ২০০ টাকা। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে নতুন কিট বাজারে সরবরাহ করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তাদের উদ্ভাবিত র্যাপিড টেস্টিং কিট উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে। [১৮ মার্চ,দ্যা ডেইলি স্টার ]
শনাক্ত করণের পর চিকিৎসা করার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দেয়া হয়নি।হাসপাতালে চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য জরুরি পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট-পিপিই ছিল না। এ অবস্থায় দেশের হাসপাতালগুলোতে আতঙ্ক বিরাজ করেছে। জ্বর, নিউমোনিয়া বা শ্বাসকষ্টের লক্ষণ নিয়ে কোনো রোগী এলে তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। এতে যেমন বিনা চিকিৎসায় রোগীমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তেমনি না জেনে করোনা আক্রান্ত রোগীকে সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসরা করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা নিরাপত্তা সরঞ্জামের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন৷ চিকিৎসকদের পক্ষে ডা. আব্দুর নূর তুষার ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন৷পরে তাদের দাবি মেনে নেয়া হলে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা আবার কাজে যোগ দেন৷ ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাসান বলেন, হাসপাতালে ২০০ ইন্টার্ন চিকিৎসক আছেন৷ তাদের জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা আগে করেনি৷ অথচ সব ধরনের রোগী হাসপাতালে আসছেন৷ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই তাদের হাসপাতালে ভর্তি করার কাজ তাদের করতে হচ্ছিল৷
জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিসের (এফডিএসআর) পক্ষ থেকে উপদেষ্টা ডা. আব্দুর নূর তুষার বলেন, ‘‘সারাদেশ থেকে চিকিৎসকরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন৷ করোনা ভাইরাস নিয়ে তারা খুব উদ্বিগ্ন৷ প্রতিদিন বহির্বিভাগে অনেক জ্বরের রোগী দেখতে হয়৷ এরমধ্যে কারো শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস আছে কিনা তা নিশ্চিত করার কোনো উপায় নেই৷ নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য মাস্ক, গ্লাভস বা কোনো পোশাকও নেই৷ অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন তারা৷ এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লংঘন বলেই মনে করি৷’’
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পক্ষে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ রশীদ স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয়েছে, ‘‘সম্পদের স্বল্পতার জন্য হাসপাতালের তরফ থেকে সকলকে মাস্ক সরবরাহ করা যাচ্ছে না৷ ঝুঁকি এড়াতে সকলকে নিজ উদ্যোগে মাস্ক ব্যবহার করতে অনুরোধ জানানো হলো৷’’এই নোর্টিশের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করেই তারা এই নোর্টিশ দিয়েছেন৷ আমরা তাদের এই নোর্টিশ প্রত্যাহারের জন্য নির্দেশ দিয়েছি৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘কাজেরও কোনো সমন্বয় নেই। আইইডিসিআর এক কথা বলে আবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা আরেক কথা বলে।”
করোনা মোকাবেলায় প্রস্তুতিতেই ঘাটতি ছিল অনেক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) চলতি বছরের জানুয়ারিতেই চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কৌশল ঠিক করে দিয়েছিল, সতর্কও করেছিল। তখন থেকে টানা তিন মাস সময় পায় বাংলাদেশ। মার্চে এসে চিকিৎসা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বড় অংশ মনে করছেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বিপদ আঁচ করতে পারেনি।[প্রথম আলো] সর্বোচ্চ প্রস্তুতি আছে বলা হলেও পরিস্থিতি যত খারাপ হচ্ছে, প্রস্তুতির ঘাটতিও পরিষ্কার হয়ে উঠছে।
১৭ মার্চ বিবিসি বাংলার “করোনাভাইরাস: সংক্রমণ ঠেকানোর সুযোগ কতটা কাজে লাগিয়েছে বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়-চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে যাবার পরে প্রায় দুই মাস সময় পেয়েছে বাংলাদেশ নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে।বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন ব্যবস্থা বাংলাদেশ শুরু থেকেই নিতে পারতো। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন যে বাংলাদেশে বিষয়টিকে প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,” করোনার বিরুদ্ধে সার্বিক এবং সমন্বিত প্রস্তুতিতে ঘাটতি আছে৷ ঘাটতি আছে প্রশাসনিক, চিকিকৎসাসহ সার্বিক প্রস্তুতিতে৷এর জন্য যে বিভিন্ন কমিটি করা হয়েছে তাতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷ টেকনিক্যাল কমিটিগুলোও ঠিকমতো হয়নি৷ এখানে সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানকে রাখা প্রয়োজন৷ আর সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে করোনাকে মোকাবেলা করতে হবে৷এর আগে আমরা এভিয়েন ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু বা মার্স করোনা ভাইরাস সফলভাবে মোকাবেলা করেছি৷ কারণ, আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ ছিল টেকনিক্যাল কমিটিগুলোতে প্রয়োজনীয় লোকজন ছিল৷’’[১৩ মার্চ,ডয়চে ভেলে]
সার্বিক ভাবে, প্রস্তুতিহীন চিকিৎসা খাত, সমন্বয়হীন পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার আতংক নিয়েই করোনা সংকটের মার্চ মাস কাটিয়েছে বাংলাদেশ।